Recents in Beach

header ads

Bay of Bengal. বঙ্গোপসাগর

বঙ্গোপসাগর

বাংলাদেশের দক্ষিণে এবং ভারত মহাসাগরের উত্তরে অবস্থিত বিশাল এক উপসাগরের নাম বঙ্গোপসাগর। ইংরেজীতে বঙ্গোপসাগরকে বলা হয় বে অব বেঙ্গল (Bay of Bengal). আয়তনের দিক দিয়ে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপসাগর। তৃভূজাকৃতির এ উপসাগরটির গড় গভীরতা প্রায় ৮০০০ ফুট। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিম দিকে ভারত, উত্তরে বাংলাদেশ  এবং পূর্বদিকে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড। আর দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা হয়ে ভারত মহাসাগরের সাথে মিলেশে এ উপসাগর।  প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে বঙ্গোপসাগরকে মহোদধি  নামে উল্লেখ করা হয়েছে যার অর্থ দাঁড়ায় বিশাল জলরাশি। হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীর সব জলরাশি আর একত্রিত অবস্থায় ছিল। প্রায় চার লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটের গতির কারনে জলভাগ আর স্থলভাগ বিভক্ত হয়ে সাতটি মহাদেশ এবং পাঁচটি মহাসাগর উৎপন্ন হয়। সেই সাথে উৎপন্ন হয় অনেক সাগর আর উপসাগর আর অসংখ্য হ্রদ।  বঙ্গোপসাগরের আয়তন প্রায় ২১৭২০০০ বর্গ কিলোমিটার। বাংলাদেশ, ভারত এবং আশেপাশের দেশগুলোর বহু নদী এসে পরেছে বঙ্গোপসাগরে। বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগরের তীরে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় দেড়শ কিলোমিটার জুড়ে সমুদ্রের তীর ঘেষে তৈরি করা হয়েছে অনন্য সুন্দর এক মেরিন ড্রাইভ রোড যা পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ রোড। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের অববাহিকতায় বাংলাদেশ এবং ভারতের উপর প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন।

বঙ্গোপসাগরের তলদেশে রয়েছে প্রচুর খনিজ সম্পদ। বঙ্গোপসাগরের অগভীর অংশের তলদেশেও হাজার হাজার ঘনফুট গ্যাস মজুদ আছে বলে ধারনা করা হয়। এছাড়াও অনেক মূল্যবান পাথরেরও সন্ধান পাওয়া গেছে এ সাগরের তলদেশে। মৎস্য সম্পদেও সম্ম্রিদ্ধ এ উপসাগরটি। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মেট্রিক টন মাছ আহরন করা হয় এ উপসাগরের গভীর ও অগভীর অংশ থেকে। রছাড়াও রয়েছে প্রচুর কাকড়া, জলজ প্রাণী, শামুক, ঝিনুক এবং হাজার হাজার প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ। শুধু খনিজ বা মৎস্য সম্পদ নয়ঃ কৌশলগত অবস্থানের জন্যও এ সাগর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ন। শুধু বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী দেশ নয় বরং বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোও বিভিন্ন সময় তাদের সামরিক মহরার অংশ হিসাবে বঙ্গোপসাগরের দিকে নজর দিয়েছে। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে ভারত এবং চীনের মধ্যে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির এক শীতল প্রতিযোগিতা চলে আসছে অনেক আগে থেকেই। সম্প্রতি ভারত এবং চীনের মধ্যে এক অঘোষিত স্নায়ূ যুদ্ধ চলছে বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে। চীন বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দেশ না হলেও তাদের বিশ্বস্থ মিত্র মিয়ানমারের সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে তারা সমুদ্রে মহরা দেয়ার সুযোগ পায়। এমনকি, বঙ্গোপসাগরের তীরে মিয়ানমারের একমাত্র সমুদ্র বন্দর ইয়াঙ্গুনের আশেপাশে চীনের গোপন সামরিক ঘাটি রয়েছে বলেও ধারনা করা হয়। বঙ্গোপসাগরের তীরে বাংলাদেশের দুটি সমুদ্র বন্দর হল চট্টগ্রাম এবং মোংলা। এছাড়াও তৃতীয় বন্দর হিসাবে পটুয়াখালীতে নির্মানাধীন আছে পারয়া বন্দর যা ২০২৩ সাল নাগাদ চালু করা সম্ভব বলে ধারনা করা হচ্ছে। এছাড়াও মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন এবং ভারতের কলকাতা ও চেন্নাই সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন বন্দরের অবস্থান বঙ্গোপসাগরের তীরে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বৈশ্বিক বাণিজ্যের একটি প্রায় ৮০ শতাংশই প্রতক্ষ্য কিংবা পরোক্ষভাবে বঙ্গোপসাগর দ্বারা প্রভাবিত।

বঙ্গোপসাগরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০০ টি দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ টি তে জনবসতি রয়েছে। সাগরের পূর্বভাগে অবস্থিত আন্দামান এবং নকোবর দ্বীপপুঞ্জ এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। এসব দ্বীপপুঞ্জগুলো ভারতের অধীনে। এছাড়া মিয়ানমারের অন্ধীনেও বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে। বাংলাদেশের অধীনে বঙ্গোপসাগরে কোন দ্বীপপুঞ্জ না থাকলেও প্রায় ৩৫ টির মত দ্বীপ রয়েছে। সেন্টাম্ররটিন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক বঙ্গোপসাগরের একমাত্র দ্বীপ যা পুরোপুরি প্রবাল দ্বারা গঠিত। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের এক অনন্য বিশ্ময় এ সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিন কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার আওতাভুক্ত একটি ইউনিয়ন।

বর্তমানে বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলাফল বঙ্গোপসাগরের উপ[অরও পরছে। সাগরের অগভীর অংশে প্লাস্টিক দূষনের ফলে বিপুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদ। তাছাড়া ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সাগরের পানির উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃধি পাওয়ার ফলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের একটি বিরাট অঞ্চল সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন। সাগরপথে প্রতিদিন প্রচুর পণ্যবাহী জাহাক যাতায়াত করে যার জ্বালানি তেলের বর্জ্য এবং অন্যান্য বর্জ্যের একটি বিরাট অংশ সাগরে পরে। এর ফলে সাগরের পানি ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে অনেক সামুদ্রিক মাছ এবং অনযান্য প্রাণী। সাগরের পানি এত স্ফপজে দুষিত হবে না বলে অনেকেই ধারনা করতেন। কিন্তু তাদের ধারনাকে ভুল প্রমান করেছে সাম্প্রতিকালে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। বেশ কয়েকটি মৃত নীলতিমি পাওয়া গেছে যেগুলোর পেটের মধ্যে ছিল প্রচুর পলিথিন আর প্লাস্টিক। এছারাও বেশ কিছু অঞ্চলে সাগরের তলদেশে কয়েক ফুট পুরু পলিথিনের স্তর পাওয়া গেছে যা ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিচ্ছে সমুদ্রের বাস্তুসংস্থান। বঙ্গোপসাগরও এ ধরনের দূষন থেকে মুক্ত নয়। বঙ্গোপসাগরের বাস্তুসংস্থান রক্ষায় এর উপকূলবর্তী দেশগুলোর আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত।

বঙ্গোপসাগরের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল, মাঝে মাঝেই বঙ্গোপসাগরের গভীরে ভয়াবহ ঘুর্নিঝর আর সাইক্লোন তৈরি হয়। বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা এবং অক্ষাংশ ক্রিয়ার ফলে এর উপরস্থ বাতাসের গতিবেগের পরিবর্তন হারিকেনের তীব্রতা সম্পন্ন ঘুর্নিঝর তৈরি হওয়ার জন্য অনেক বেশি সহায়ক। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ভয়ঙ্কর সিডরের আঘাতে এর উপকূলবর্তী দেশসমুহের প্রায় ২৫ হাজার লোক মারা যায়। ১৯৯১ সালে ভয়াবহ ঘুর্নিঝরের ফলেও প্রচুর লোকের প্রানহানি ঘটেছিল। এছাড়াও প্রতিবছরই এ সাগরে ঘুর্নিঝর তৈরি হয়। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তা উপকূলের নিকটবর্তী এলাকায় আসার আগেই দুর্বল হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয় এবং বৃষ্টিপাত ছড়ানোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যায়।

পরিশেষে বলা যায়, বঙ্গোপসাগর এর উপকূলবর্তী দেশসমুহের জন্য একটি সম্পদ। শুধু শিল্প বা বাণিজ্য নয় বরং এ অঞ্চলের জলবায়ূকে সমভাবাপন্ন রাখার পেছনেও বঙ্গোপসাগরের ভূমিকা অনেক বেশি।

Post a Comment

0 Comments