সুন্দরবন

বাংলাদেশ এবং ভারত দুই দেশের মধ্যে বিস্তৃত এক অবিচ্ছিন্ন ম্যানগ্রোভ বনভূমির নাম সুন্দরবন। বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষী আর বাগেরহাট এবং ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা আর দক্ষিন চব্বিশ পরগনার একটি বিরাট অংশ জুড়ে এ ম্যানগ্রোভ বনের অবস্থান। সরকারী হিসাবে সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার হলেও বর্তমানে এ বনের বিরাট একটি অংশ বিলীন হয়ে গেছে দুই দেশের বনদস্যুদের অত্যাচারে। সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী এবং গেওয়া। এছাড়াও রয়েছে পশুর, দুন্দল, পাইন চাপালিশ সহ আরও বহু প্রজাতির উদ্ভিদ। সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষন রয়েল বেঙ্গল টাইগার যা বাংলাদেশের জাতীয় পশু। তবে, ক্রমবর্ধমান বন উজারের কারনে আজ এ বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে একটি বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সুন্দরবনের উচ্চতা স্থানভেদে ২ থেকে ৭ ফুট। প্রতিদিন দুইবার সুন্দরবনের একটি বিরাট অংশ সমুদ্র এবং এর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীসমুহের লোনা পানিতে ডুবে তৈরি হয় অস্থায়ী জলাবদ্ধতা। এটি আসলে ম্যানগ্রোভ বনভূমির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর প্রতিনিয়ত এমন জলাবদ্ধতার কারনেই সুন্দরবনের মাটিতে লবণের পরিমাণ অত্যাধিক। সুন্দরবনের মধ্যে  জালের মত ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নদী এবং খাল। এসব নদী এবং খালের মধ্যে বেশ কয়েকটি পানিই লবণাক্ত। এসব জলাভূমিগুলোর আশেপাশে গোলপাতা নামক এক ধরনের বৃক্ষ জন্মে যা স্থানীয়রা ঘরের ছাউনি তৈরিতে ব্যবহার করে। সুন্দরবনে প্রচুর হিংস্র প্রাণী, হরিণ, প্রায় ৩২ প্রজাতির বানর, বেশ কয়েক প্রজাতির সরীসৃপ, অমেরুদন্ডী প্রাণী এবং বহু প্রজাতির পাখি আছে। জলাভূমি গুলোতে আছে প্রচুর মাছ। এছাড়া প্রচুর কীট পতঙ্গ আছে এ বনে। সুন্দরবনে অনেক মধুর চাক তৈরি হয়। সুন্দরবনে যারা মধু সংগ্রহ করে তাদের মৌয়াল বলা হয়। একেকটি মধুর চাক থেকে অনেক সময় দশ কেজি পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা যায়। সুন্দরবনের আশেপাশে যারা বসবাস করে তাদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ সুন্দরবনের নদী ও খালগুলোতে মাছ শিকারের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে।

হাজার হাজার বছর আগে নদী আর সাগরের অববাহিকায় সমুদ্রের জোয়ার ভাটার প্রভাবে গঠিত হয়েছে এ ম্যানগ্রোভ বন। একক বন হিসাবে এটিই বিশ্বের সর্ব বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্বের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ঘোষনা করে। এ অঞ্চলের প্রাচীন মানচিত্রগুলোতে সুন্দরবনের নামকরন করা হয়েছিল সমুদ্রবন হিসাবে। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের মানচিত্রগুলোতে সুন্দরবনের অবস্থান পাওয়া গেলেও এর আয়তন সম্পর্কে কোন সঠিক ধারনা পাওয়া যায় না। ঐ সময় সুন্দরবন বাঘ ভাল্লুক সহ নানা রকম হিংস্র জানোয়ারে পরিপূর্ন থাকায় কেউ হয়ত জরিপ কাজে সফল হতে পারে নি। বৃটিশরা সর্ব প্রথম  সুন্দরবন এলাকা জরিপ করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান বন বিভাগ গঠন করে সুন্দরবনের তদারকির দায়িত্ব বন বিভাগের উপর অর্পন করা হয়। ১৯০৩ সালে বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া নামক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডেভিড প্রেইন তার লিখিত Flora of Sundarban নামক গ্রন্থে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র সম্পর্কে গবেষনামূলক এবং বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরেন। বইটিতে তিনি সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। মজার বিষয় হল, সারা পৃথিবীতে মাত্র ৫০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ পাওয়া যায় ৩৬ প্রজাতিই সুন্দরবনে পাওয়া যায়।

বহূ পূর্ব থেকেই কাঠ আহরণের এক বিরাট ক্ষেত্র হিসাবে ভূমিকা পালন করে আসছে সুন্দরবন। আর এ কারনেই হয়ত বনদস্যুদের নজরও বনের দিকে পরেছে। আর প্রতিনিয়ত সাবার হচ্ছে বনজ সম্পদ। বঙ্গোপসাগরে মাঝে মাঝেই বড় বড় ঘুর্নিঝর আর সাইক্লোন তৈরি হয়। এসব ঘুর্নিঝর থেকে উপকূলীয় অধিবাসীদের জীবন রক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে সুন্দরবন। ২০০৭ সালে ঘুর্নিঝর সিড সুন্দরবনের যে পরিমান ক্ষতি সাধন করেছে তা পুষিয়ে উঠতে একশ বছরেরও বেশি সময় লাগবে। আর সুন্দরবনের ক্ষতি সাধনের ফলেই ঘুর্নিঝরের ভয়ঙ্কর প্রভাব থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে উপকূলীয় প্রায় অর্ধ কোটি মানুষের জীবন। বাংলাদেশেকে ঝর, বন্যা, জলোচ্ছাস থেকে রক্ষার জন্য সুন্দরবন কার্যত একটি প্রাকৃতিক ঢাল হিসাবে কাজ করে।

সুন্দরবন বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটন স্পট। দেশী-বিদেশী প্রচুর পর্যটক প্রতি বছর সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখার জন্য এখানে ঘুরতে আসে। সুন্দরবনে প্রবেশ করতে হলে বন বিভাগের অনুমতির প্রয়োজন হয়। সেই সাথে বন বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত ফর্মালিটি মেন্টেইন করে তাদের থেকে একজন গার্ডও সাথে নিতে হয়। বনের ভেতরে ঢুকলেই প্রথমে চোখে পরবে শত শত বানর। বিভিন্ন প্রজাতির বানরের খুনসুটি আর দুষ্টুমি একজন দর্শককে মুহূর্তের জন্য হলেও মুগ্ধ করবে। এছাড়া নানা প্রজাতির সাপ এবং অন্যান্য ছোট ছোট সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী চোখে পরবে। সুন্দরবনের সাপগুলো বেশ বিষাক্ত। এদের থেকে একটু সাবধানতা বজায় রাখতে হবে। যদি ভাগ্য ভাল হয় তাহলে চোখে পরতে পারে হরিণও। চমৎকার মায়া হরিণ বাংলাদেশের এক অনন্য সম্পদ। এছাড়া চিত্রা হরিণও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্র, শিক্ষক এবং গবেষকদের জন্য সুন্দরবন এক অসাধারন স্থান। তবে, সুন্দরবন ভ্রমনের আসল উদ্দেশ্য হাসিল করতে হলে আপনাকে লঞ্চ ভাড়া করে বনের গহীনে প্রবেশ করতে হবে। তাহলেই শুধু আপনার কানে আসতে পারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন। আগে খুব সহজেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে এদের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় বাঘের দেখা পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণের মত।

সুন্দরবন আমাদের সম্পদ। আমাদের দেশের সম্পদ। শুধু আমাদের নয় বরং সারা পৃথিবীর সম্পদ। কাজেই এ বন রক্ষার দায়িত্বও আমাদের সকলের। আমরা যখন বনের মধ্যে ঘুরতে যাই তখনও আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। বনের মধ্যে পলিথিন এবং প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ফেলা মোটেই উচিত নয়। এমনকি বনের একটি গাছের পাতাও যাতে আমাদের হাত দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেদিকে সর্বদা দৃষ্টি রাখা উচিৎ। তাছাড়া এ বন রক্ষার জন্যও সরকারের আরও বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে  সুন্দরবন থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার মূল্যবান কাঠ পাচার হয়। সামান্য মুনাফার লোভে জবাই করা হয় সুন্দরবনের রত্ন খ্যাত মায়া হরিণ। এছাড়াও সুন্দরবনের পশুর নদী অতিক্রম করার সময় বেশ কয়েকবার তেলবাহী কিছু ট্যাংকার জাহাজ ফুটো হয়ে ক্ষতিকর তেল ছড়িয়ে পরেছে নদীর সর্বত্র। এ তেলের প্রভাবে প্রচুর মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা গিয়েছে। এসব বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিৎ। ক্ষতিকর তেলবাহী জাহাজ সুন্দরবনের নদীগুলোতে প্রবেশ করানোর আগে অবশ্যই তা পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। এছাড়া বন বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা উচিত। সরকারী দলের নাম ব্যবহার করে যেসব ভূমিদস্যু এবং বনদস্যু সুন্দরবন এবং আশেপাশের জনগোষ্ঠীকে জিম্মি করে রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহন করতে হবে।

আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষতাই পারে সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে। এখন থেকেই যদি আমরা পূর্ন মনযোগের সাথে কাজ শুরু না করি তাহলে আর একশ বছর পর সুন্দরবনের অবস্থান হয়ত হবে ইতিহাসের পাতায়। বন রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সংশ্লীষ্ঠ বিভাগগুলোর সঠিক সমন্ময়।